কিউবায় তখন কিউবান হিরকরাজা বাতিস্তা দেশ শাষন করছে। সেই স্বৈরাচারি হিরক সরকাকে উৎখাতে করার চেষ্টার অভিযোগে তখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। তাকে আদালতে হাজির করা হলে কাঠ গড়ায় দাড়িয়ে ফিদেল দীর্ঘ এক বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যে উঠে আসে কিউবায় মানুষের উপর শোষন নির্যাতন লুটপাটের কথা। তিনি তুলে ধরেন কিভাবে কিউবাকে অসাধু ধনী আর লুটেরা মাফিয়াদের হাতে তুলে দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রেখেছেন মার্কিন গোলাম বাতিস্তা সরকার। এ থেকে উত্তরনের জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোন পথ নেই। আর সেই কাজটিই করছেন ফিদেল ও তার সঙ্গীরা। আদালতে তিনি গর্বের সাথে স্বিকার করেন তারা স্বশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছেন এবং এটাই দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে তাদের কর্তব্য!
ফিদেল সেই জবানবন্দিতে বলেন- কিউবার ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে ৮৫ ভাগ জমির জন্য ভাড়া দেয় (মানে বর্গা চাষী) এবং যে জমিতে কৃষিকাজ করে তার থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ভয় তাদের বারবার তাড়া করে ফেরে। আমাদের উর্বর ভূমির অর্ধেকের বেশি বিদেশিদের আওতায়। …ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি এবং ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির আওতায় আছে সবচেয়ে বেশি জমি…। আর এদিকে ২০ লাখ ক্ষেত মজুর পরিবার আছে যাদের মালিকানায় এক একর জমিও নেই, যাতে ফসল ফলিয়ে তারা তাদের শিশুদের মুখে খাদ্য তুলে দিতে পারে। অন্যদিকে ৩০ লাখ কৃষি উপযোগি জমি প্রভাবশালী মানুষদের দখলে আছে , তা অনাবাদী পড়ে আছে। কিউবা যদি যর্থাথই একটি কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে, যদি এর জনগণ গ্রামীন হয়ে থাকে, আর শহরগুলো যদি সেই গ্রামীন জনপদের উপরই নির্ভরশীল হয়, যখন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই গ্রামীন জনপদের মানুষই লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনে, যে গ্রামীন জনগণ ভূমিকে ভালোবাসেন এবং জানেন কীভাবে এর দেখাশোনা করতে হয় আর এখন যদি সেই জনগণই তাদের কার্যক্রমের জন্য রাষ্ট্রের উপরে নির্ভর করে তাহলে বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা কী করে প্রবহমান থাকতে পারে?
‘জন উপযোগী জিনিসের একচ্ছত্র বানিজ্য কখনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। কারণ ওই পরিস্থিতিতে তারা ব্যবসার পথটি অনেক লম্বা করে ফেলে যতক্ষন না সেটা লাভজনক হয়। আর এ পর্যন্ত যেতে যদি মানুষ বাকি জীবন অন্ধকারে কাটায় তাতে তাদের কিছু আসে যায়না।’
ফিদেল সেদিন কিউবায় বিপ্লবের মাধ্যমে কিভাবে সম্পদের সুষম বন্টন হবে, কিভাবে মানুষের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে সেসব রুপরেখা দিয়ে জনগণকে বিপ্লবে অংশ নিতে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, এই স্বৈরাচারি সরকারের আদালত আমাকে দোষী হিসেবে রায় দিলেও ইতিহাস আমায় মুক্তি দিবে।
ইতিহাস ফিদেলকে শুধু মুক্তি দেয়নি তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কারণ কিউবায় বিপ্লব ঘটিয়ে সেই দূরবস্থা থেকে জনগণকে মুক্ত করেছিলেন ফিদেলরা। আর তাই কিউবার মানুষের কাছে ফিদেল এক অনন্য নাম। কিউবাতে যখন নিজের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো মার্কিন সরকার তখন তারা কিউবাকে রোগে শোকে মারতে চাইলো। বন্ধ করে দিলো চিকিৎসা সহায়তার সব পথ। ফিদেল ও তার সঙ্গীরা জনগনকে নিয়ে লড়াই করে দাড় করালো বিশ্বের অন্যতম সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা! কিউবাকে ওরা খাদ্যে মারতে চাইলো বন্ধ করে দিলো সার কীটশানক সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে দিতে চাইলো কৃষি ব্যবস্থা। ফিদেলরা শুরু করলো অর্গানিক কৃষি লড়াই! ওদের জমি এখন উর্বর জমি ওদের কৃষি এখন অন্যতম পরিশুদ্ধ কৃষি। কিউবার জনগণকে অশিক্ষা কুশিক্ষায় মারতে চাইলো ফিদেলরা দাড় করালো বিজ্ঞানভিত্তিক একটি সুসভ্য শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানেই বাধা দিয়েছে সেখানেই লড়াই করেছে। এখনো লড়ছে বিপ্লবী কিউবা…। লড়ছে বলে সম্পদের অভাব আছে কিন্তু অনাহারে মৃত্যু নেই! সংকট আছে কিন্তু গৃহহীন নেই , চিকিৎসাহীন নেই, শিক্ষাহীন কোন মানুষ সেখানে নেই! এই কিউবা মাথা উচু করেই বেঁচে আছে ফিদেল যেমনটি বলেছিলো।
তাইতো ফিদেল কাস্ত্রো কে জনগনের হৃদয়ে ঠাই পেতে নামের মার্কেটিং করতে হয়নি। এ সম্পর্কে বাংলাদেশি পর্যটক অনু তারেক কিউবা ভ্রমনে গিয়ে লিখেছিলেন- ‘ব্যক্তি ফিদেল কাস্ত্রোকে আজ এক ঘটনায় অন্তত ১০গুণ বেশী ভালোবেসে ফেললাম। ফিদেলের ছবিয়ালা টিশার্ট দেখে অনেকেই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল, আজ কয়েকজন বৃদ্ধা রাস্তায় জিজ্ঞাসা করল এই টিশার্ট কোথায় পেলে।
বললাম নিকারাগুয়ায় কিনেছি, কিন্তু আসলাম বাংলাদেশ থেকে, তো তোমাদের এমন ফিদেল শার্ট নেই?
তারা মাথা নেড়ে জানালেন ফিদেলের টিশার্ট, ছবিওয়ালা টুপি, পোষ্টার কোন কিছু করারই অনুমতি নেয়, স্বয়ং ফিদেল বেঁচে থাকলেও কিউবার কোন টাকায় তাঁর ছবি ছিল না, তাঁর নামে একটি রাস্তাও নেই, কোন প্লাজা নেই কিউবায়, কারণ ফিদেল মনে করতেন, ব্যক্তি মরণশীল, কিন্তু আদর্শ অমর। মানুষ যদি ব্যক্তি ফিদেলকেই পূজা করা শুরু করে তাহলে আদর্শের দিক থেকে হটে যেতেই পারে, তাই তাঁর নামে কিছুই বিশেষ করে কোন CULT শুরু হবার বিরুদ্ধে ছিলেন সবসময়ই।
আজ এই মহান কিংবদন্তির জন্মদিন। ১৯২৬ সালের ১৩ই আগস্ট এই দিনে কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরে। যিনি জন্মেছিলেন শুধুই বিপ্লবের জন্য, মানব মুক্তির জন্য, জমাট বাঁধা অন্যায়ের প্রতিবাতের জন্য । সারা পৃথিবীতে মানুষের মুক্তি আর সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে আজও সমোচ্চারিত তিনি